জৈব-অস্ত্রের তৈরি করতে গিয়ে কোভিড-১৯-এর উদ্ভব?

বিশেষ প্রতিবেদন :এই শতকের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক রহস্য। চিনের শহর উহানের এক বাজার থেকেই কি কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎপত্তি? এই শহরেই ঘটনাচক্রে রয়েছে উহান ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজি। নাকি এই ভাইরোলজি প্রতিষ্ঠানেই চিনের ভয়াবহ সামরিক গবেষণার ফল এই করোনাভাইরাস?

বিজ্ঞানীরা এখন একমত, যে-অতিমারি গোটা পৃথিবীকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে তা নিশ্চিত ভাবে উহানের ওই ইন্সটিটিউটের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা মূর্তিমান এক বিপদ। সেই সঙ্গে রয়েছে চিনা সামরিক বিভাগের অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ গবেষণা। উঠে আসা নতুন তথ্য এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

তদন্তকারীরা পর্বতপ্রমাণ তথ্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন এবং গোটা বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলছেন। তাঁরা নিশ্চিত, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ ভাইরাস এক টিকা-সংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষার পরিণতি হিসেবে বেরিয়ে এসেছে। যদিও এই টিকার খোঁজ পরবর্তীকালে জৈব-অস্ত্র অনুসন্ধানের দিকে ঘুরে যায়।

ভারতের প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট শাহিদ জামিল বলেন,”যতদিন যাচ্ছে তত আমি নিশ্চিত হচ্ছি যে, দুর্বল জৈব-নিরাপত্তার জন্য সামরিক গবেষণার ফাঁক গলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে অনেকগুলি ধোঁয়াশা রয়েছে।”

এই রহস্যের সূত্রপাত ঘটে ইউনান প্রদেশে মোজিয়াং অঞ্চলে পরিত্যক্ত এক তামার খনির গভীরে। ২০১৬ সালে। চিনের গবেষকরা তখনও পর্যন্ত অজ্ঞাত করোনাভাইরাস জড়ো করে রেখেছিলেন। এই তথ্য প্রথম আমেরিকানদের কাছে যায় কেননা তারাই এই গবেষণার অর্থ জোগাচ্ছিল। কিন্তু পরে, চিন গোটা তদন্তকে গভীর গোপনীয়তার মোড়কে ঢেকে ফেলে। এক বিস্তারিত বিবরণে এমনটাই জানিয়েছে সানডে টাইমস।

উহান ইন্সটিটিউটে চলা করোনাভাইরাস গবেষণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে চিনের সামরিক বিভাগ। বিশেষ করে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ঝৌ ইউসেন। তিনি সামরিক বিজ্ঞানী। ঝৌ পাদপ্রদীপের তলায় আসেন যখন তিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কোভিড-১৯-এর টিকার পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন। চিনে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার মাত্র পাঁচ সপ্তাহ পরে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এত দ্রুত গতিতে কোনও টিকা আবিষ্কার করা একপ্রকার অসম্ভব।

আরও রহস্যজনক ব্যাপার হল, ২০২০ সালের মে মাসেই মারা যান ঝৌ। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীদের বলতে শোনা গেছে,”উহান ইন্সটিটিউটের ছাদ থেকে পড়ে যান ঝৌ।” যদিও তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু, ঝৌয়ের মৃত্যুকে প্রায় গোপন রাখা হয়।

শুরুতে ডিরেক্টর শি ঝেংলির নেতৃত্বে উহান ইন্সটিটিউট যুক্তরাষ্ট্র সরকার-পোষিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করছিল। তাদের থেকে অর্থও পাচ্ছিল। তবে, করোনাভাইরাস আবিষ্কার ও মোজিয়াং-এর ঘটনার পর চিনের তরফ থেকে তথ্য কম দেওয়া হতে থাকে।

সার্সের মতো উপসর্গ নিয়ে মোজিয়াং অঞ্চলে বহু লোক মারা গিয়েছিল। চিনারা এই সত্য চেপে যায়। উহান ইন্সটিটিউটে চলা অধিকাংশ গবেষণা ও আমেরিকানদের মদতে চলা পরীক্ষানিরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল সার্স মোকাবিলা করতে পারে এমন টিকা আবিষ্কার করা। ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে পূর্ব এশিয়াকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল এই সার্স।

সানডে টাইমস লিখেছে,”বিশ্বকে সতর্ক করার পরিবর্তে চিনা কর্তৃপক্ষ এর ক্ষতির দিকগুলি জানায়নি। যে ভাইরাস সেখানে পাওয়া গিয়েছে এখন তাকে কোভিড-১৯ গোত্রেরই একটি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাক-অতিমারির সময় এই ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল। এরপর নথিপত্র ধোঁয়াটে হতে শুরু করে।”

সানডে টাইমস বিস্তারিত যে তত্ত্ব তুলে এনেছে তা নতুন নয়। ২০২০ সালের মে মাসে, পুনের এক বিজ্ঞানী দম্পতি মোনালি রাহালকর ও তাঁর স্বামী রাহুল বাহুলিকর প্রায় একই বিষয়ের কথা জানিয়েছিলেন। তাঁদের গবেষণাপত্রে জোর দেওয়া হয়েছিল ছয়জন খনিকর্মীর উপর যাদের নিয়োগ করা হয়েছিল মোজিয়াং খনিতে বাদুড়ের মল পরিষ্কার করার কাজে। এই কর্মীদের শরীরে নিউমোনিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। পরে এদের তিনজন মারা যান।

তবে, চিনের উহানের বাজার থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহপোষণ করেন একদল বিজ্ঞানী। করোনাভাইরাস ছড়ানোর পিছনে চিনের হাত থাকার তত্ত্বকেও সংশয়ী দৃষ্টিতে দেখেন।

‘ল্যাব লিক’ তত্ত্বকে চিন ‘ভ্রান্ত’ বলে ঘোষণা করেছে। এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ নামে একটি জার্নালে ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি পেপারে রাহালকর ও বাহুলিকরের তত্ত্বকে জোরালোভাবে নস্যাৎ করা হয়েছে। যুক্তি দেওয়া হয়েছে, মোজিয়াং-এ কর্মীদের কোভিড-১৯ বা সার্স কিছুই হয়নি। এই পেপারে জোর দিয়ে বলা হয়, মোজিয়াং খনিতে সার্স-কোভ-২ ছিল না। ভাইরোলজিস্ট জামিল বলেন,”মোজিয়াং খনি ভাইরাস ও সার্স-কোভ-২-এর মধ্যে সরাসরি কোনও যোগসূত্র দেখানো হয়নি এই পেপারে। তবে, কে কাকে উৎপন্ন হতে সাহায্য করেছে বা তারা পরস্পরের কত কাছাকাছি তার উত্তর দিতে পারেনি এই সন্দর্ভ।” এ দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তদন্তকারীদের দাবি, ওই ইন্সটিউটে এক গোপন প্রকল্পে অর্থ ঢালছিল চিনের সামরিক বিভাগ যাতে ভয়ানক ভাইরাস তৈরি করা যায় এবং যেগুলিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

চিনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বা সিডিসির প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক জর্জ গাও গত মাসে জানান, ল্যাব-লিক তত্ত্বকে একেবারে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হচ্ছে না, এমনটা নয়। গাও একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাইরোলজিস্ট। বিবিসি রেডিও ৪-কে তিনি বলেন,”এটাই বিজ্ঞান। কিছুকে বাদ দিয়ে দেওয়া যায় না।”

গাও এখন চিনের ন্যাশনাল ন্যাচারাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অধিকর্তা। তিনি বলেন, কোভিডের উৎপত্তি কীভাবে হল তা জানতে চিন সরকার তদন্তের ব্যবস্থা করেছিল। এরই সঙ্গে তিনি যোগ করেন,”আমার মনে হয়, তাদের মূল কথা হল, তারা সমস্ত নিয়ম মেনে চলছিল। তারা কোনও ভুলভ্রান্তির হদিশ পায়নি।”